কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগে টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের বাগান সৃজন ও নার্সারিতে চারা উত্তোলনের উপকরণ সরঞ্জাম ক্রয়ে ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। খোদ উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন সরকার লোটপাটে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। গত দুইদিন ধরে তাঁর কাছে এই প্রকল্পের তথ্য চাওয়া হলে প্রথমে তিনি কক্সবাজার সদর রেঞ্জ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
তাঁর পরামর্শ মতে রোববার সকালে সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা দপ্তরে গেলে তিনি এইসব তথ্য ডিএফও'র কাছে বলে জানিয়ে দেন। পুনরায় রোববার সন্ধ্যায় ডিএফও'র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তথ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে বলেন, তথ্য নিয়ে কি করবেন? তথ্য দিলে তো উল্টাপাল্টা লিখেন। একপর্যায়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করার পরামর্শ দিয়ে সংযোগ বিছিন্ন করে দেন তিনি।
সূত্র মতে, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগে ২০১৯-২০ অর্থ বছর থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত চার অর্থবছরে সুফল প্রকল্পের নার্সারী ও বাগান সৃজনের উপকরণ সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য ই-টেন্ডারের মাধ্যমে ১৭ কোটি ১৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এই বরাদ্দের টাকায় কত হেক্টর বাগান করা হয়েছে এবং কোন কোন ঠিকাদার মালামাল সরবরাহ করেছে জানতে চাইলে কোন তথ্য দেননি কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন সরকার।
সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ই টেন্ডারের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩ কোটি ৮০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার টাকাসহ মোট ১৭ কোটি ১৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
বরাদ্দের ওই টাকায় ঠিকাদার কর্তৃক ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ, বাঘখালী রেঞ্জ, ফুলছড়ি রেঞ্জ, মেহেরঘোনা রেঞ্জ, জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জ, ঈদগাঁও রেঞ্জ ও ঈদগড় রেঞ্জে নার্সারী ও বাগান সৃজনের জন্য রোপন সরঞ্জাম, বীজ, বাশের খুটি, পচনশীল গোবর, অস্থায়ী শেড সামগ্রী, বাঁশ, রাসায়নিক সার, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রের জন্য কীটনাশক, দোআঁশ মাটি, সুতলি, পলি ব্যাগ, হালকা ইস্পাতের তার, বাশের চাটাই, চারা বৃদ্ধির জন্য সানগ্রাস, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাসায়নিক সার ও আরসিসি সাইন বোর্ডের জন্য উপকরন সামগ্রী সরবরাহ করার নিয়ম রয়েছে। যদিও বনবিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন তার উল্টো। নার্সারী উত্তোলন ও বৃক্ষরোপন সরঞ্জামের হিসেব শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রেখেছেন ঠিকাদার ও বিভাগীয় কর্মকর্তা। নাম মাত্র কিছু রাসায়নিক সার, পলি ব্যাগ, সুতলি, খুটি, গোবর সরবরাহ করেছেন ঠিকাদার। বাকী মালামাল সরবরাহ না করে বরাদ্দের বেশিরভাগ টাকা ঠিকাদার ও ডিএফও মিলে ভাগ করেছেন। একই কথা জনিয়েছেন এক রেঞ্জ কর্মকর্তা ও কয়েকজন বিট কর্মকর্তা। তারা জানান, নার্সারী ও বাগানের জন্য ঠিকাদার কর্তৃক মালামাল সরবরাহ করার কথা থাকলেও কয়েক পদ ছাড়া তারা কিছুই পায়নি।
বনবিভাগের মাস্টার রুলে কর্মরত শ্রমিক ও মাঝিরা জানিয়েছেন, বিট কর্মকর্তা, রেঞ্জ কর্মকর্তা ও ঠিকাদার কর্তৃক দোআশ মাটি তারা পায়নি। তারা নার্সারির স্থানের আশপাশ থেকে মাটি সংগ্রহ করে নার্সারির কাজ চালিয়েছে। নার্সারি ও বাগানের জন্য খুটি ও বাঁশ তারা বন-জঙ্গল থেকে কেটে ও বাজার থেকে কিনে এনে ব্যাবহার করেছে। পচনশীল গোবর বনে বসবাস বিভিন্ন ব্যাক্তির কাছ থেকে বিনামূল্যে সংগ্রহ করে নার্সারি করা হয়েছে। বাগানের রক্ষাণাবেক্ষনের রাসায়নিক সারও তারা পায়নি। কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রের জন্য কীটনাশক চোখেও দেখেনি তারা। চারা বৃদ্ধির জন্য সানগ্রাস ও আরো বিভিন্ন সরঞ্জামাদি তারা পায়নি। সুতলি ও পলিব্যাগ দেওয়া হয়েছে শুধু। যদিও ঠিকাদার কর্তৃক এসব সরঞ্জামাদি পাননি এ কথা কাউকে উর্ধতন কর্মকর্তারা নিষেধ করেছেন বলে জানিয়েছেন মাঝি ও শ্রমিকরা।
সরেজমিনেও দেখা গেছে একই চিত্র। বনবিভাগ যেসব বাগান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার হিসেব শুধু কাগজে-কলমে ও সাইনবোর্ডে সীমাবদ্ধ। সাইনবোর্ডে বাগানের চারার সংখ্যা ও গাছের প্রজাতির কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার কোন মিল পাওয়া যায়নি। আবার কোন জায়গায় বাগানের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চারার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া যে চারা গুলো লাগানো হয়েছে অনেক গাছের চারা প্রথম বছরেই মারা গেছে । দ্বিতীয় বছরে সার দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। পরিচর্যার অভাবে মারা গেছে অধিকাংশ চারা।
একই অভিযোগ তোলা হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে মাঠ পর্যায়ে পৌছায়নি নার্সারি ও বাগান সৃজনের সরঞ্জাম। তাই পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রথম বছরেই মারা গেছে ৪০ শতাংশ চারা। দ্বিতীয় বছরে কম্পোস্ট সার দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরিচর্যার অভাবে দ্বিতীয় বছরেও মারা গেছে ২০-৪০ শতাংশ চারা।
এইসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সোমবার সকালে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন সরকারের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি তিনি।
এ প্রসঙ্গে সুফল প্রকল্পের পরিচালক গোবিন্দ রায় বলেন, বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে। আমি ডিএফও কে বলে দিব আপনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য। তিনি আপনাকে সব প্রশ্নের সমাধান দিবেন।
এ প্রসঙ্গে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, টেন্ডারের সম্পূর্ণ মালামাল ওয়ার্ক অর্ডারে উল্ল্যেখিত বিট ও রেঞ্জ অফিসে সরবরাহ করতে হবে। কোন কর্মকর্তাকে নগদ টাকা প্রদানের মাধ্যমে মালামাল কেনার সুযোগ নেই। যদি এরকম হয়ে থাকে তদন্ত করে কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে।